লা জবাব লাদাখ – পর্ব ৩

Share

লাদাখ – প্রকৃতির একটি অত্যাশ্চর্য্য সৃষ্টি ৷ তার অবর্নণীয় রূপের সঙ্গে আর কোন জায়গার মিল খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর আমার মনে হয় ৷ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ধরিত্রীর যে রূপের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার সঙ্গে আমাদের দেশের এই প্রান্তটির কোন মিল নেই বললেই চলে ৷তবু লাদাখ আমাদের স্বপ্নের দেশ ৷ ঘন নীল দোয়াতের কালিমাখা আকাশ, রঙ-বেরঙ্গের পাহাড় , রামধনুরঙা জলরাশির সরোবর….দেখেছো তোমরা কেউ….একসাথে ?

ladakh-4-part3-sumitradas

লাদাখের রঙ মিনিটে মিনিটে তার রূপ পাল্টায় ৷ সবটাই নির্ভর করে তার আকাশের রঙের ওপর ৷ আকাশের রঙ সরোবরের জলের ওপর বরফঢাকা পাহাড়ের ওপর যেমন যেমন পড়ে, তেমনই প্রতিফলিত হয় ৷ তাই সরোবর কখনো দোয়াতের কালিরঙা ঘন নীল, কখনো পান্না সবুজ, আবার কখনো মেঘছায়ে বিবর্ণ ঘোলাটে সাদা ৷ পাহাড়ের শুভ্রমুকুট কখনো নীলাম্বর আকাশে ঝকঝকে উন্নত শিরে, কখনো দিগন্তের শেষ আলোয় স্বর্ণাভ আবার কখনো দল বেঁধে যাওয়া মেঘেদের রঙে ধূসর ৷

লাদাখের কথা বলে শেষ করা যাবে না একদিনে ৷ তারচেয়ে বরং আজ আমরা সেই লেকগুলির সুন্দর সুন্দর ছবি দেখতে দেখতে কি করে সেখানে পৌঁছানো যায় , কারা আমাদের ভ্রমণসঙ্গী ছিল সেই গল্প করতে করতে এগিয়ে যাই ৷

ladakh-1-part3-sumitradas

লাদাখের অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে রয়েছে এখানকার লেক অথবা সরোবরগুলি ৷ সমগ্র লাদাখ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এরা ৷ এদের মধ্যে প্যাংগং, সো মোরিরি, আলথাকের নাম উল্লেখযোগ্য ৷

চাংলা পাস উতরাই পথে ৩৮ কিমি গেলে ছোট্ট শহর তাংসে ৷তাংসে যাবার পথে বহু দূর থেকে একটা নীল রিবন চোখে পড়ছিল ৷ গাড়ী একটা করে বাঁক নিচ্ছে আর নীল রিবনের আয়তন বাড়ছে ৷ হঠাৎ দেখি চারপাশটা রঙীন পাহাড়ে ঘেরা শান্ত নির্জন পরিবেশ……তারই মাঝে অপরূপ একটি সরোবর…নাম তার আলথাক ৷ ইতিহাসে উপেক্ষিত এই সরোবরটির নাম খুব বেশী শোনা যায় না ৷ কিন্তু রামধনুরঙা জলরাশির এই সরোবরটিকে না দেখলে আমার অন্ততঃ লাদাখ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেতো ৷

তাংসে থেকে ৩২কিমি দূরে লুকুং নালা পেরিয়ে , তৃণগুল্মহীন ধূসর চরাচর পেরিয়ে আমরা চলেছি সেই বহু আকাঙ্খিত স্থানটির উদ্দেশে ৷ কিন্তু তার আগে যে সবুজ – মেরুণ আর মাখনরঙা পাহাড়গুলোর কথা বলতে হয়, যারা হাত ধরাধরি করে সারিবদ্ধভাবে আমাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে ৷ বর্ষার কারণে রাস্তা বেশ খারাপ ছিল ৷ এইসব প্রতিকূলতা জয় করে সেই সারি সারি পর্বতমালার মাঝখান দিয়ে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত সুনীল জলরাশির এক অপার্থিব শোভা চোখে পড়লো, যখন প্রকৃতির সেই অপূর্ব মহিমার সামনে দাঁড়ালাম, সেই বিস্মিত মুহূর্তটিই বোধহয় লাদাখ সফরের শ্রেষ্ঠ মহার্ঘ প্রাপ্তি ৷এই কি তবে স্বর্গ ? একেই কি বোধহয় বলে বাকরুদ্ধ হওয়া !

ladakh-9-part3-sumitradas

প্যাংগং ও চ্যাংচেনমো পর্বতমালার মাঝে প্যাংগং লেকের অবস্থান ৷ ১৪,২১৭ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ইংরেজী ‘এল’ অক্ষরের আকারের এই সরোবরের মোট দৈর্ঘ্য ১৩০কিমি ৷এর মধ্যে ৪০ কিমি ভারতে আর ৯০কিমি চীন অধিকৃত তিব্বতে ৷ এশিয়ার বৃহত্তম নোনা জলের এই সরোবরের রঙের বৈচিত্র্যে মন অভিভুত হয়ে যায়৷ এর রূপের ছটায় আকর্ষিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে কত যে মানুষ ছুটে আসে ! অবর্নণীয় সেই সৌন্দর্য্য ! তীরের কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মতো পান্না সবুজ…।যার মধ্যে দিয়ে লেকের জলের তলার পাথরকুচি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ৷ একটু দূরে ময়ুরকণ্ঠী নীল , কোথাও বা ফিরোজা , আবার অ-নে-ক দূরে ঘন নীলরঙা জলের সম্ভার ৷ তারপরেই দাঁড়িয়ে আছে রং-বেরঙের পর্বতশ্রেণী ৷ আহা , কি দৃশ্য !বাতাসের দাপটে জলে ওঠে ঢেউ ৷ তারই মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে ব্রাহ্মণী হাঁসের ঝাঁক ৷ মাঝে মাঝে বিচিত্র আওয়াজে ডেকে উঠছে ৷

ladakh-10-part3-sumitradas

কি যে অদ্ভুত মন কেমন করা অনুভুতি…লিখে কি বোঝানো যায় সেই অপরূপ অনভুতির কথা ? ফিরে তো আসতেই হবে ৷ আর হয়তো কোনদিন আসবো না স্বর্গের কাছাকাছি এই স্বপ্নপুরীতে ৷নির্জনতার নীলিমায় নীল এই চোখ ধাঁধানো রূপ ,তার আসা-যাওয়ার পথের ধারে যে দৃশ্যাবলী, যা’ মনের মণিকোঠায় রয়ে গেল, কোনদিন কি তাকে ভুলতে পারবো…ভোলা সম্ভব ???


sumitra das author
শ্রীমতি সুমিত্রা দাস
শ্রীমতি সুমিত্রা দাস

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা নিরিবিলি পাহাড়ী শহর দার্জিলিঙে বড় হয়ে ওঠা৷ শুধু শহর দার্জিলিঙ নয় ,কার্শিয়াং,টুং,মার্গারেট’স হোপ চা-বাগানের মত ছোট ছোট পাহাড়ী নিঃস্বর্গভূমির অপরূপ পরিবেশের মধ্যে জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে ৷ তাই প্রকৃতিকে তাঁর দ্বিতীয় মা মনে করেন ৷আকাশচুম্বী পাইন, দেবদারু,শ্যাওলা জড়ানো ধূপি গাছের সারি,নাম-না-জানা চঞ্চলা কিশোরী ঝর্ণা ,ছোট বড় জলপ্রপাতের আছড়ে পড়ার গা ছমছমে আওয়াজ ,পাহাড়ের কোলে অনামী ফুলের সমারোহ,ঝকঝকে রূপালী চাদর মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা ,লাল লাল গালের ফুটফুটে নেপালী ছেলেমেয়ে ….এরা সবাই ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ৷ফটোগ্রাফীর সাথে তাঁর অনেক পুরোন প্রেম ৷ বাবা ছিলেন খুব ভাল চিত্রশিল্পী ও আলোকচিত্রশিল্পী ৷ সেখান থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ৷

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা জায়গায় বারবার ছুটে যাওয়া আর প্রকৃতিকে নিজের ক্যামেরায় বন্দী করতে মন উতলা হয়৷ এভাবেই ২০১৬ সালে  অনন্য সৌন্দর্য্যের লাদাখের হাতছানিতে ছুটে যাওয়া ,তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য্যে বাকরুদ্ধ হওয়া ৷
এছাড়া জীবনকে যারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে ,সেইসব মানুষের পাশে থেকে হাত ধরতে ভাল লাগে ৷ পৃথিবীর আলো যাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ,অন্তরের আলো জ্বেলে  যারা আলোময় করে তুলছে নিজেদের জীবন,সেইসব ছেলেমেয়েদের  জন্য তৈরী অডিও লাইব্রেরীতে তাদের প্রয়োজনীয় বই পাঠ করে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ৷ সুমিত্রার কাছে এ’ এক পরম প্রাপ্তি ৷


4 Comments

  1. Satyabhama Chatterjee says:

    asadharon. sab porbo guli porlam. khub valo legeche.

    1. Sumitra Das says:

      গভীর কৃতজ্ঞতা ৷একবার ঘুরে এলে জীবন সার্থক মনে হবে ৷

  2. Sanjukta Bhattacharyya says:

    jetei hobe chobi tolar jnyo. ki asadharon drishyo. lekhatio khuub valo legeche amar.

    1. Sumitra Das says:

      খুব ভাল লাগল ৷ একবার ঘুরে এসো ৷ সারাজীবনের অভিজ্ঞতা মনে হবে ৷ পারলে ক্যামেরা নিয়ে যেও ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *